ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে হলের বারান্দায় আসতেই দিলটা “খুশ” হয়ে গেল নিলয়ের। চমৎকার ঝকঝকে রোদ ধুয়ে দিচ্ছে চারপাশটাকে। আকাশটা ভীষণ নীল। মনে হচ্ছে কেউ যেন নীল রং ঢেলে দিয়েছে সমস্ত আকাশজুড়ে। কী অসহ্য সুন্দর!
জোড়া শালিক হলুদ হলুদ পা ফেলে ঘাসের মধ্যে পোকা ধরছে। ঘাসগুলো যেন সবুজ গালিচা বিছিয়ে রেখেছে। মৃদু বাতাসে তির তির করে কাঁপছে সাদা ঘাসফুলগুলো। নারিকেল, আম, জাম আর কাঁঠালের বনে দীর্ঘশ্বাসের মতো একটা বাতাস উঠল হুট করে। আমের শাখাগুলো দুলছে, হাতছানি দিয়ে ডাকছে যেন নিলয়কে; আয় নিলয়, আয়…
নাস্তা করে এসে কী করবে ঠিক বুঝতে পারল না নিলয়। ছুটির দিন আজকে। ক্লাস কিংবা ল্যাবের কোনো ঝামেলা নেই। আরেকবার সেঁটে ঘুম দেবে কি না ভাবছে, এমন সময় মনে হলো “ধুর! ঘুম দিয়ে লাভ নেই। তারচেয়ে একটা মুভি দেখি। কী জানি একটা নতুন বাংলা মুভি এসেছে শোভন বলছিল… উমম… মনে পড়ছে… ওটাই দেখি।”
ইউটিউবে গিয়ে মুভি দেখা শুরু করল নিলয়। গতানুগতিক কাহিনি। একটু পরেই একটা গান শুরু হয়ে গেল। আইটেম সং। নিলয় ভদ্র ছেলে। শুক্রবার ছাড়াও মাঝে মাঝে মসজিদে যায়। আইটেম সংয়ের কাণ্ডকারখানা দেখে লজ্জা পেয়ে গেল। স্কিপ করে গেল পুরোটা। একটু পর শুরু হলো আরেকটা গান। আইটেম সং না হলেও যথেষ্টই অশ্লীল। এবার কিছুক্ষণ, কিছুক্ষণ না পুরোটাই দেখল সে। ভেতর থেকে কে যেন তাকে বলল, আরে ব্যাটা দেখ, একবার দেখলে কিছুই হয় না।
পুরোটা মুভি যখন সে দেখে শেষ করল তখন ওর অবস্থা বেশ খারাপ। কান গরম হয়ে গেছে। হার্টবিট খুব বেড়ে গেছে। জোরে জোরে নিশ্বাস পড়ছে। বাইশটা বসন্ত পার করে দেয়া তৃষ্ণার্ত শরীর জেগে উঠেছে। নিলয় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সেই আইটেম সংটা (প্রথম বার এটা দেখেই সে লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলেছিল) বেশ কয়েকবার দেখল। তারপর একটা-দুইটা করে বেশ কয়েকটা দেখে ফেলল। ভেতর থেকে ওর ভালো মানুষের সত্তাটা বার বার নিষেধ করছিল। সেটাকে পাত্তা দিলো না সে একবারেই। উত্তেজনা বাড়তে থাকল। একসময় জঘন্য কাজটা করে ফেলল নিলয়। ঠান্ডা হবার পর হুঁশ ফিরল। গভীর অবসাদ তাকে গ্রাস করল। একটু আগেও যে সোনালি রোদ্দুরে ভরা পৃথিবীটাকে অনেক সুন্দর মনে হচ্ছিল, আল্লাহ্কে (সুবঃ) বার বার ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছিল সে পৃথিবীটাকেই এখন ভীষণ স্যাঁতস্যাঁতে, অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে হচ্ছে।
মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কতবার এভাবে নিজের নফস আর শয়তানের কাছে পরাজিত হতে হবে জানে না নিলয়।
এভাবেই উদ্দেশ্য গোপন করে কালে কালে, যুগে যুগে, আদম (আঃ) আর হাওয়া (আঃ) থেকে শুরু করে তাঁদের সন্তানদের ধোঁকা দিয়ে চলেছে ইবলিস। সে কখনোই সরাসরি আপনাকে বলবে না, “যা পর্ন দেখ” বা “হস্তমৈথুন কর”। ধাপে ধাপে অত্যন্ত ধৈর্য ধরে আগাবে সে। প্রথম ধাপটা সে আপনার কাছে খুব আকর্ষণীয় করে রাখবে। সে কাজটা করার জন্য আপনার সামনে অনেক লজিক নিয়ে আসবে। আদম (আঃ) আর হাওয়াকে (আঃ) যেভাবে ধোঁকা দিয়েছিল ঠিক সেভাবেই। ঘটনাটা আমরা সবাই জানি। আল্লাহ্ (সুবঃ) আদম (আঃ) আর হাওয়াকে (আঃ) একটা গাছের ফল খেতে নিষেধ করেছিলেন। এমনকি সে গাছের কাছে যেতেও নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু শয়তান তাদের সেই গাছের ফল খাইয়েই ছেড়েছিল। শয়তান প্রথমেই উনাদের বলেনি, “তোমরা এই নিষিদ্ধ গাছের ফল খাও।” শয়তান প্রথমে আদম (আঃ) আর হাওয়া (আঃ) গিয়ে বলল, “দেখো! আমি তোমাদের বন্ধু, আমি তোমাদের উপকার করতে চাই। তোমরা যদি এই গাছের ফল খাও, তাহলে তোমরা চিরযৌবন পেয়ে যাবে। চিরকাল এই জান্নাতে থাকতে পারবে।”
তাঁরা শয়তানের ধোঁকায় পড়ে আল্লাহ্র (সুবঃ) আদেশ অমান্য করে ফল খেলেন, শাস্তিস্বরূপ আল্লাহ্ (সুবঃ) তাঁদের চিরসুখের জান্নাত থেকে বের করে পাঠিয়ে দিলেন এই দুঃখ-কষ্টে ভরা দুনিয়াতে।
বনি ইসরাইলের বারসিসার ঘটনাটাও শয়তানের স্টেপ বাই স্টেপ ধোঁকার আরেকটি ক্ল্যাসিক উদাহরণ। অত্যন্ত ইবাদতগুজার বারসিসাকে শয়তান ধীরে ধীরে ধোঁকায় ফেলে এক তরুণীর প্রেমে মশগুল করে দেয়। তারপর তার সঙ্গে যিনা করিয়ে নেয়। মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হলে ইবলিস বারসিসাকে প্ররোচনা দেয় তাকে মেরে ফেলতে। সবশেষে বারসিসাকে বাধ্য করে শয়তানের উদ্দেশে সিজদাহ করতে।
আপনাকে কাবু করার জন্য সে একই রকম ফাঁদ পাতবে। প্রথম স্টেপটা হবে আপাতদৃষ্টিতে খুবই সাধারণ, নিরীহ একটা বিষয়। রাস্তাঘাটে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকা, মাঝেমধ্যে মুভি দেখা, ইউটিউবে একটু ভিডিও দেখা, কোনো মেয়েকে ফেইসবুকে ফলো করা, প্রোফাইল পিকচারে লাইক দেয়া, মাঝেমধ্যে চ্যাট করা, বা “বোনের মতো”/ “জাস্ট ফ্রেন্ড” মেয়েবন্ধুদের সাথে একটু আড্ডা দেয়া, হ্যাং আউট করা ইত্যাদি। এ কাজগুলো করতে আপনার মন খুঁত খুঁত করলে হাজারটা যুক্তি খাড়া করবে সে আপনার সামনে; আরে একদিনই তো…, মাঝেমধ্যে বিনোদনেরও তো একটু দরকার আছে নাকি! ইসলাম কি এতই কঠোর? আমি তো শুধু চ্যাটই করছি, প্রেম তো আর করছি না…, মেয়ে দেখলে কী আর এমন হবে; আল্লাহ্র (সুবঃ) এত সুন্দর সৃষ্টি, মা শা আল্লাহ্ দেখব না কেন? আমরা ও রকম না, একসাথে বসে আড্ডা দিলেও, একই রিকশায় ঠাসাঠাসি করে বসলেও আমাদের মনে খারাপ কিছু আসে না—আমরা জাস্ট ফ্রেন্ডস… এ রকম হাজার হাজার যুক্তি।
যদি শয়তানের পাতা এই ফাঁদে একবার পা দেন, তাহলেই ফেঁসেছেন। বেশ ভালো সম্ভাবনা আছে শয়তানের হাতে নাকানি-চুবানি খেয়ে নিজের জন্য জাহান্নামের গর্ত বুকিং করার। নিজের ওপর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কারণে ভাবতে পারেন, আরে ধুর! অযথায় ভয় দেখাচ্ছেন আপনি… আমাকে কখনো শয়তান নাকানি-চুবানি খাওয়াতে পারবে না, উল্টো আমিই তাকে দৌড়ানি দেবো। ওই প্রথম স্টেপই কেবল, তারপর তো আর আগাচ্ছি না। আপনার মতোই বারসিসাও ভেবেছিল যে, “ওই প্রথম স্টেপ পর্যন্তই। তারপর তো আর আগাচ্ছি না।” কিন্তু একসময় হাঁটি হাঁটি পা পা করে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় সবগুলো স্টেপস পার করে শয়তানকে সিজদাহ করার মতো জঘন্য পাপ করে বসেছিল। আপনার ক্ষেত্রেও যে এমনটা হবে না, তার গ্যারান্টি কী। বারসিসা ছিল খুবই বড় একজন ইবাদাত-বন্দেগী করনেওয়ালা (আবিদ)। কিন্তু শেষমেষ তারই এমন করুণ পরিণতি হয়েছিল—আমি, আপনি কোনো ছার।[1]
তা ছাড়া, আল্লাহ্ (সুবঃ) নিজেকে নিজেই ফিতনাহতে ফেলতে নিষেধ করেছেন। তিনি কিন্তু বলেননি তোমরা যিনা কোরো না, তিনি বলেছেন যিনার কাছেও যেয়ো না।[2]
কাজেই আত্মবিশ্বাসী হয়ে ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে নিজেকে এই সব ফিতনাহর মধ্যে ফেলার কোনো মানেই হয় না। আত্মবিশ্বাস ভালো, তবে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস কেবল বোকাদেরই থাকে। রংবাজি করার আরও অনেক জায়গা পাবেন, এখানে না করাই ভালো। জান্নাত-জাহান্নামের প্রশ্ন এটা। বাস্তবতাটা বোঝার চেষ্টা করুন। আপনি খুব ভালো করেই জানেন কোন কোন বিষয়গুলো আপনাকে ফিতনাহর মধ্যে ফেলে। কোন ট্রিগারগুলো একটু একটু করে আপনাকে পর্ন দেখতে, হস্তমৈথুন করতে বা আসল যিনা করে ফেলতে ধাবিত করে। সে বিষয়গুলোর তালিকা করুন। ট্রাকের পেছনে লেখা থাকে, দেখেছেন না—১০০ হাত দূরে থাকুন? সেভাবেই যিনার দিকে ধাবিত করা সেই বিষয়গুলো থেকে ১০০ হাত দূরে থাকুন। ধারেকাছেও ঘেঁষবেন না। শয়তানকে কোনো সুযোগই দেবেন না। কোনো যুক্তিই মানবেন না।
[1] বারসিসার কাহিনিটা পড়ে আসুন এই লিংক থেকে – http://bit.ly/2nabgeZ
[2] সূরা বনি ইসরাইল; ১৭ : ৩২