বিসমিল্লাহির রহমানীর রহীম।
কংক্রিটের রাস্তায় পড়ে থাকা কোল্ড ড্রিংক্সের খালি বোতলে কষে একটা লাথি মেরে রাগ আর বিরক্তি দুটোই একসঙ্গে ঝাড়লো রুম্মান । “ধুউউর! পেটে খিদে রেখে এভাবে পার্কের বেঞ্চিতে কতক্ষন বসে থাকা যায়” ?
সেই দুপুর থেকে সে বসে আছে এই বেঞ্চিতে । এখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলল । পেটে দানাপিনা কিছুই পড়েনি টিফিনের পর ।
সামনের বেঞ্চিতে আধাশুয়ে থাকা উশকো খুশকো চুলের গাল ভাঙ্গা লোকটা তার ইঁদুরের মতো পিটপিটে লাল চোখ দিয়ে অনেকক্ষন ধরে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্কুল ড্রেস পড়া রুম্মানের দিকে । রুম্মান অস্বস্তিবোধ করতে শুরু করলো । ঐ গাঞ্জাখোর ব্যাটাটা ছিনতাইকারী না হয়েই যায় না ।
“গাধা কোথাকার ! আমার কাছ থেকে ছিনতাই করার মতলবে আছে , আমার পকেটেতো একটা ছেঁড়া দুটাকার নোটও নেই” মনে মনে ভাবলো রুম্মান ।
সেই দুপুরে স্কুল ছুটি দিলেও বাসায় যেতে ভয় পাচ্ছে রুম্মান । বেশ কয়েকবার বাসায় যাবার জন্য রওয়ানা দিয়ে আবার মাঝপথ থেকে ঘুরে এসেছে , সাহসে কুলোয়নি । আজ বাসায় গেলে তার বাবা তাকে “বানাবেই”। সূর্য সকালে ওঠে – সন্ধায় অস্ত যায় , গরু ঘাস খায় এইগুলো যেমন ধ্রুব সত্য , তেমনি আজকে সে যে তার বাপের হাতে ডলা খাবে সেটাও ধ্রুব সত্য।
গত সপ্তাহে ক্লাসের টেক্সট বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে ক্যান্ডি ক্রাশ খেলার সময় সে বাবার হাতে ধরা খেয়ছিল রেড হ্যান্ডেড – তখনো তার বাবা তাকে কিছু বলেননি । গত সপ্তাহের আগের সপ্তাহে সে দুপুরবেলা বাসা থেকে পালিয়ে হাজির হয়েছিল পাড়ার মাঠে । বীর পুরুষের মতো কাঠফাটা রোদে ক্রিকেট খেলে জ্বর বাঁধিয়ে বিছানায় পড়ে ছিল সে বেশ কয়েকদিন , তখনো তার বাবা তাকে কিছু বলেননি । কিন্তু আজকে আর রক্ষা নেই । আজকে মিড এক্সামের রেজাল্ট কার্ড দিয়েছে এবং সে দুইদুইটা সাব্জেক্টে ডাব্বু মেরে বসে আছে ।
ছিনতাইকারীর উটকো ঝামেলা থেকে বাবার হাতে পিট্টি খাওয়া ভাল। যা আছে কপালে ভেবে রুম্মান বেঞ্চি থেকে স্কুল ব্যাগটা তুলে কাঁধে নিয়ে , পানির খালি বোতলটা হাতে নিল । মক্তবের হুজুরের কাছ থেকে যত সূরা ক্বিরাত শিখেছিল ছোট বেলায় তার সব বিড়বিড় করে পড়তে পড়তে হন হন করে হাঁটা দিল বাসার দিকে । …প্লিজ! আল্লাহ আজকে পার করাইয়া দাও , সামনের শুক্রবার থেকেই নামাজ ধরব ,কথা দিলাম, পাক্কা , প্লিজ আল্লাহ প্লিজ ।
সুবহানাল্লাহ! মানুষের সাইকোলজিটাই এমন যে , মানুষ যখন অন্য কাউকে রাগিয়ে দেয় তখন সে তার সামনে যেতে ভয় পায় , ইতস্তত বোধ করে । শয়তান আদম সন্তানের ঠিক এই দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে ফন্দি আঁটে আদম সন্তানকে তার পরম করুণাময় অসীম দয়ালু রবের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ।
শয়তান আর নফসের পাল্লায় পড়ে ভয়াবহ পাপ করে ফেলেছেন – মনে করুন যে পর্ন মুভি দেখে ফেলেছেন বা মাস্টারবেট করে ফেলেছেন । হরমোনের প্রেসার কমার পর আপনার খেয়াল হল – হায়! হায়! আমি এ কি করলাম? অনুশোচনার আগুনে আপনি দগ্ধ হচ্ছেন , ধিক্কার দিচ্ছেন নিজেকে। তৎক্ষণাৎ গোসল করে এসে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন; উদ্দেশ্য তওবা করা ।
রঙ্গমঞ্চে আগমন হল শয়তান ব্যাটার । আপনাকে ওয়াসওয়াসা দিতে শুরু করল ,“ কিরে ভন্ড! একটু আগে আল্লাহর নফরমানী করে আবার এখন এসেছিস তওবা করতে ? যা ভাগ ! তোর দেখি কোন লজ্জা শরম নাই, আল্লাহ’র সামনে দাঁড়াচ্ছিস কোন মুখে ? আল্লাহ কি তোকে মাফ করে দিবে মনে করেছিস”?
আপনি ভেবে দেখলেন – কথার মধ্যে তো বেশ যুক্তি আছে । দ্বিধা দ্বন্দে ভোগা শুরু করলেন তওবা করবেন কি করবেন না , ভুলে গেলেন আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সাঃ) তওবা করাকে কতটা উৎসাহিত করেছেন …
নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন যারা তাঁর কাছে তওবা করে, এবং তিনি তাদেরকে ভালবাসেন যারা নিজেদেরকে পবিত্র করে।
—কুরআন, সূরা ২ (আল-বাকারা), আয়াত ২২২
অবশ্যই আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করবেন, যারা ভূলবশত মন্দ কাজ করে, অতঃপর অনতিবিলম্বে তওবা করে, এরাই হল সেসব লোক যাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন; আল্লাহ মহাজ্ঞানী রহস্যবিদ।
—কুরআন, সূরা ৪ (আন-নিসা), আয়াত ১৭
প্রত্যেক আদম সন্তানই পাপ করে, পাপীদের মধ্যে তারাই সর্বোত্তম যারা তওবা করে।
—সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং- ২৪৯৯
সহিহ বুখারীতে, আনাস ইবনে মালিক বর্ণনা করেন:
আল্লাহর রাসূল বলেন, “তোমাদের কেও মরুভূমিতে হারিয়ে যাওয়া উট খুঁজে পেয়ে যতটা খুশি হয়,আল্লাহ তাঁর বান্দার তওবাতে তাঁর চেয়েও বেশি খুশি হন।”
ব্যাস শয়তানের প্ল্যান সার্থক ।
শয়তানের কুমন্ত্রনা একেবারেই পাত্তা দিবেননা , আপনাকে ভন্ড বললেও সে আসলে নিজেই ভন্ড । যে কোন পাপ করার পর এক মাইক্রোসেকেন্ডও দেরি না করে তৎক্ষণাৎ তওবা করুন , বহুত “ফায়দা” হবে।
“হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর সমীপে খাঁটি তওবা কর, এই আশায় যে তোমাদের প্রভু তোমাদের সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন আর তোমাদেরকে এমন উদ্যানসমূহে উপবিষ্ট করবেন যার নিম্নদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত থাকবে…”
—কুরআন,সূরা ৬৬ (আল-তাহরিম), আয়াত ৮
জালালুদ্দিন রুমী কী চমৎকার ভাবেই না বলেছেন –
“কড়া নাড়ো, তিনি তোমায় দরজা খুলে দেবেন
বিলীন হয়ে যাও, তিনি তোমায় সূর্যের মত উজ্জল করবেন
লুটিয়ে পড়ো, তিনি তোমায় বেহেশতে তুলে নেবেন
নিজেকে রিক্ত করো, তিনি তোমায় সবকিছু দিয়ে পূর্ণ করবেন”।
শয়তান বেচারার মন খুব খারাপ । এত চেষ্টার পরেও আপনার তওবা করা ঠেকাতে পারলো না । তার ষড়যন্ত্রের বাউন্সার, দুর্দান্ত হুক করে আপনি পাঠিয়ে দিয়েছেন মাঠের বাইরে । সে বুঝে ফেলেছে আপনাকে তওবা করা থেকে ফেরানোর মুরোদ ও’র কেন ও’র বাপ দাদা চৌদ্দগুষ্ঠির কারো নেই । কিন্তু তারপরেও দমে গেল না বেচারা । আবার রঙ্গমঞ্চে হাজির হল নতুন ফন্দি এঁটে – এই তওবা দিয়েই ঘোল খাইয়ে ছাড়বে আপনাকে। খেলা হবে ।
কুমন্ত্রণা দিতে শুরু করল আপনাকে – আগে পর্ন মুভিটা দেখ তার পর তওবা করে ফেললি । আরে ব্যাটা জানিস না তওবা করলে আল্লাহ কি পরিমাণ খুশি হয় ? সব পাপ মাফ করে দেয়” ? তুইও মজা পেলি আর আল্লাহও খুশি হল !!! সাপও মরলো লাঠিও ভাংলো না !!!
ভাই, এরকম প্ল্যান করে পাপ করার পর তওবা করলে , তওবা কি কবুল হবে ? আল্লাহ (সুবঃ) খুশি হবেন ? আপনিই বলুন কমনসেন্সটা কাজে লাগিয়ে ?
বিষয়টা অনেকটা এরকম – আপনি রাস্তায় কাউকে বলা নেই কওয়া নেই মনের সুখে কিল থাপ্পড় চড় ঘুষি মেরে, মুখের জিওগ্রাফি বদলে দিয়ে সরি বললেন – তারপর ঐ বেচারা কি হাসিমুখে চেহারার রক্ত মুছতে মুছতে বলবেন – ইটস ওকে ব্রো ? নাকি মামা চাচা দোস্ত সব্বাইকে ফোন করে শার্টের হাতা গুটিয়ে আপনার দিকে তেড়ে আসবে – তবে রে ব্যাটা …
আল্লাহ (সুবঃ) যে কাজ হারাম করেছেন সেই কাজ এভাবে প্ল্যান করে করলে আল্লাহ (সুবঃ) এর সঙ্গে কি রসিকতা করা হয়ে যায় না ? আল্লাহর সঙ্গে রসিকতা !!!
আর তাছাড়া – পর্ন দেখা অবস্থায় বা মাস্টারবেট করা অবস্থায় মারা গেলে কবরে বা হাশরের ময়দানে কেমন আদর আপ্যায়ন পাবেন সেটাও চিন্তা কইরেন ।
সাধু সাবধান । শয়তান এরকম কুমন্ত্রনা দিতে শুরু করলে বিতাড়িত শয়তান থেকে চটজলদি আশ্রয় চান আল্লাহর কাছে । ল্যাপটপ , ফোন (যেটাতে আপনি পর্ন মুভি দেখার প্রিপারেশান নিচ্ছিলেন) বন্ধ করে দিয়ে ওই যায়গা ছেড়ে চলে যান দূরে । মানুষ জনের কাছে । খুব ভালো হয় সঙ্গে সঙ্গে ওজু করে দুই রাকাত সলাত আদায় করতে পারলে । আরো ভালো হয় জোরে আযান দিতে পারলে – জানেনইতো – আযান শুনলে শয়তান পাদু করতে করতে এলাকা ছেড়ে পালায় – দূর হ ব্যাটা পাঁজির পা ঝাড়া শয়তান! দূর হ! দূরে যেয়ে মর ………
(চলবে ইনশা আল্লাহ)
পড়ুন-