Published on

বৃত্তের বাইরেঃ পর্নোগ্রাফি থেকে মুক্তি

যদিও বিষয়টি নতুন, পর্নোগ্রাফি পৃথিবীর প্রায় সকল শ্রেণীর মানুষকে আক্রান্ত করেছে। পুরনো দিনগুলোই ভালো ছিল, কারণ তখনকার লোকজন এরকম কোন বিষয়ের মুখোমুখি হয়নি যেটি তাদেরকে কামনা ও যৌনলালসার গোলাম বানিয়ে দেয়। প্রতি মাসে প্রায় ৭.৫ কোটি লোক প্রাপ্তবয়স্কদের (adult) ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে, সার্চ ইঞ্জিনে প্রায় ২৫ শতাংশ সার্চ থাকে পর্নোগ্রাফি সম্পর্কিত এবং পর্নোগ্রাফি থেকে সারাবিশ্বে আয় হয় প্রায় ৫৭ বিলিয়ন ডলার।

ইন্টারনেট আসার আগে, আত্মনিয়ন্ত্রণহীন ও আত্মসম্মানহীন কিছু লোক দোকানে প্রাপ্তবয়স্কদের (adult) ম্যাগাজিন বা ভিডিও কিনতে যেতো, কিন্তু এখন বাড়িতে বসে এবং সবার চোখের আড়ালেই এগুলো পাওয়া সম্ভব।

“সবার চোখের আড়ালে” কথাটা ঠিক না, আল্লাহ তা’লা সবসময় তো দেখছেনই।

একটি ওয়েবসাইটে এই বিষয়ের সামাজিক দিকগুলো নিয়ে খুব ভালো আলোচনা আছে। যেসব লোক পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত, যারা এটা থেকে বিরত হওয়ার চেষ্টা করছেন এবং যারা এ আসক্তি থেকে ফিরে এসেছেন তারা সবাই সেখানে তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। কিছু জনপ্রিয় বক্তাদের কাছ থেকে ইসলামিক উপদেশও যুক্ত করা হয়েছে। সবকিছু প্রকাশ করা সম্ভব না হলেও, এ ধরনের আসক্তি থেকে সফলভাবে ফিরে আসার গল্প ও কিছু উপদেশ সংযুক্ত করা হয়েছে, যেটি এ ধরনের অভ্যাস থেকে ফিরে আসতে সাহায্য করবে। তেমনি কিছু টিপস নিয়েই আমাদের এই লিখাটি।

...আমি ২৫ বছর বয়সের একজন যুবক, আমি পর্ন আসক্তি ও হস্তমৈথুন আসক্তি থেকে ফিরে আসার চেষ্টা করছি। আমার বয়স যখন ১০-১১ বছর, তখন হঠাৎই হস্তমৈথুন শুরু করি। তখন বুঝতে পারিনি আমি কি করছি এবং আমি জানতাম না যে এটা হারাম (আমি এটা গোপনে করতাম, যদিও আমি তখন ছোট ছিলাম তবুও আমি বুঝতাম যে এটা খারাপ)। যাইহোক, আমি এটা প্রায় ২ বছর পর্যন্ত চালিয়ে যাই এবং তারপর একদিন পর্নোগ্রাফি আবিষ্কার করি। আমি বিব্রত বোধ করতাম বলে দোকান থেকে ম্যাগাজিন কিনতে পারতাম না, তাই আমি পর্নোগ্রাফি সম্পর্কিত বিষয় এর জন্য বড়দের পুরনো বইপত্র খোঁজাখুঁজি করতাম।

আমি অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতাম এবং আমার বাবা-মা ঘুমিয়ে পড়লে শেষ রাতের অশ্লীল অনুষ্ঠান দেখার জন্য টি.ভি. চালিয়ে রাখতাম। (আমি এগুলো গোপনে দেখার জন্য দরজা ভিড়িয়ে রাখতাম এবং কেউ আসার শব্দ পেলে সাথে সাথে তা লুকিয়ে ফেলতাম)।

একসময় বিষয়টা আমার কাছে খুব খারাপ মনে হলো এবং আমি নিজেকে অপরাধী বোধ করলাম। তাই বিষয়টা নিয়ে আমার বাবার সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলাম, তখন আমার বয়স ছিলো ১৩। তিনি এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করলেন এবং আমাকে কিছু বাস্তবধর্মী উপদেশ দিলেন। উপদেশগুলো কয়েকমাস পর্যন্ত কাজ করলো এবং আমার বাবা মনে করলেন যে তিনি সফল হয়েছেন। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত আমি আবার আগের অভ্যাসে ফিরে গেলাম।

আমি এগুলো কয়েকবছর পর্যন্ত চালিয়ে গেলাম, আমার বয়স ১৫/১৬ হওয়া পর্যন্ত (এই সময়টাতে আমার নিজেকে অপরাধী মনে হয়েছে, কিন্তু তারপরও আমি চালিয়ে গিয়েছি)। এটা হওয়ার কারণ, ইন্টারনেট সহজলভ্য হয়ে গিয়েছিল। এর ফলে পর্ন ভিডিও দেখা আমার জন্য অনেক সহজ হয়ে গেলো (এগুলোর জন্য কোন দোকানে যাওয়ার দরকার ছিলো না, বরং ইন্টারনেটে বিভিন্ন ধরনের পর্ন ভিডিও সহজেই পাওয়া যেত)।

পর্নআসক্তি মাদকাসক্তির মতোই, আপনি এখানে বিনামূল্যে যুক্ত হতে পারবেন, তারপর যখন পুরোপুরি আসক্ত হয়ে পড়বেন তখন আপনি বাধ্য হবেন বিক্রেতার কাছে ফিরে যেতে। কিন্তু আপনাকে টাকা খরচ করতে হবে আরো উন্নত মানের পর্ন ভিডিও পাওয়ার জন্য। প্রায় দুই বছর পর আমি লক্ষ্য করলাম বিনামূল্যে পাওয়া পর্ন ভিডিওগুলো আমার জন্য যথেষ্ট না, আমার চাহিদা বাড়তে থাকায় তা মেটানোর জন্য আরো বেশি পর্ন ভিডিও প্রয়োজন। এক কথায় বলতে গেলে, যতই দিন যাচ্ছিল ততই এসবের চাহিদা বাড়তে থাকলো। আমার বয়স যখন প্রায় ২০, তখন আমি এ সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় হিসেবে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলাম।

দুর্ভাগ্যবশত, বিয়ে করার পর কয়েকমাস এগুলো থেকে বিরত থাকলেও আমি আবার আগের অভ্যাসে ফিরে গেলাম।

যাইহোক, প্রায় এক বছর আগে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমার এতটা নীচে নামার কারণ হচ্ছে আমার ভেতরের পশুত্ব, এটা আমাকে সব দিক থেকে গ্রাস করেছে। আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি এই পশুটাকে হত্যা করার জন্য, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি।

তারপরও, এক বছর আগে এমন কিছু একটা ঘটেছিল যার ফলে আজ আমি এই ফোরামে বলতে পারছি যে, আমি এই পশুটাকে হত্যা করেছি। আসলে আজ আমার বিজয়ের প্রথম বর্ষপূর্তি। অন্যান্য আসক্তদের মতো আমারও মনের ভেতর ধারণা ছিল যে, আমি হয়ত নিজেকে বেশিদিন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবো না। এক বছর আগে আমি যখন এসব থেকে ফিরে আসলাম, তখন বুঝতে পারলাম যে, আমার মনের ভেতরের এই ধারণা দূর করতে হবে। কারণ, এই ধারণা আমার ফিরে আসাকে অর্থহীন করে দেবে। তাই আমি স্থির হয়ে বসে পর্নোগ্রাফির সব খারাপ প্রতিক্রিয়াগুলো সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করলাম এবং নিম্নোক্ত প্রতিক্রিয়াগুলো খুঁজে পেলামঃ

১। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এটি আপনাকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাবে।

২। সবসময় নিজেকে অপরাধী ও নিরর্থক মনে হবে।

৩। সবসময় নিজের কাছে লজ্জিত হবেন, যার ফলে নিজের আত্মসম্মান ও আত্মবিশ্বাস কমে যাবে।

৪। মূল্যবান সময় নষ্ট হবে, যে সময়টাতে নতুন কিছু শেখা বা বন্ধুদের সাথে উপভোগ করতে পারতেন।

৫। নিজের কাজগুলোকে গোপন রাখার জন্য মিথ্যা বলতে হবে এবং এই মিথ্যাগুলোকে ঢাকার জন্য আবার মিথ্যা বলতে হবে, এভাবে চলতেই থাকবে।

৬। স্ত্রীর সাথে দৈহিক মিলন খুবই অস্বাভাবিক মনে হবে।

৭। স্ত্রীর সাথে দৈহিক মিলনের পর যে তৃপ্তি পাওয়া যায় তার তুলনায় হস্তমৈথুন এর আনন্দ খুবই সামান্য।

৮। সত্যিকথা বলতে, পর্নোগ্রাফি এবং পতিতাদের পেছনে ১০ বছরে আমি প্রায় ১৫০০০ ইউরো নষ্ট করেছি। এই অর্থ আমি গরিবদের দান করতে পারতাম, ১০ বার ছুটিতে ভ্রমণ করতে পারতাম অথবা অন্তত ৪-৫ বার পবিত্র মক্কা নগরীতে ভ্রমণ করতে পারতাম।

৯। ভালো কাজ (যেমন আল্লাহ্‌কে খুশি করার জন্য কুরআন পড়া বা মুসলিমদের সাহায্য করা) এসব কাজের প্রতি অনাগ্রহ তৈরি হয়। কারণ, সবসময় মনে হয়, আমি এত খারাপ কাজ করেছি, এখন ভালো কাজ করে আর কি হবে?

১০। আমি পর্ন ভিডিও দেখছি, এই বিষয়টা আমার স্ত্রীর জন্য অনেক কষ্টকর ছিল। আমার কাছেও এটা অনেক অপমানজনক ছিল, কারণ আমি তার সাথে প্রতারণা করছিলাম।

সুতরাং, আমি কীভাবে এটা থেকে মুক্তি পেলাম?

এটা আসলে নিচের কাজগুলোর সমন্বয়ের ফলে হয়েছেঃ

১। আমি সবসময় উপরের ১০টি খারাপ প্রতিক্রিয়া স্মরণ করার চেষ্টা করতাম। (আমি এগুলো লিখে নিয়েছিলাম এবং প্রতিদিন পড়তাম।)

২। প্রতিদিন কুরআন পড়তাম, দোয়া করতাম এবং দান-খয়রাত করতাম।

৩। বাসায় যথাসম্ভব একা না থাকতে চেষ্টা করতাম।

৪। সময়মত নামায আদায় করতাম।

৫। আমরা যখন বাসায় থাকতাম তখন আমার স্ত্রীকে বলতাম আকর্ষণীয় পোশাক পড়তে।

৬। পর্ন ভিডিও দেখা এবং হস্তমৈথুনের পর নিজেকে কি পরিমাণ অপরাধী, হতাশ ও লজ্জিত মনে হয় সেটা সবসময় স্মরণ রাখতাম।

৭। অনেকেই আমার সাথে একমত হবেন যে, যখন কেউ একাকী ও বিষণ্ণ বোধ করে এবং হাতে অলস সময় থাকে তখন সে পর্ন ভিডিও দেখে। অলস সময় কীভাবে কাটাতে হয় সে ব্যাপারে ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। কিছুদিন আগে আমি একটি ইসলামিক বয়ান শুনেছি, সেখানে ইমাম বলছিলেন অলস সময়ে শয়তান সহজেই ধোঁকা দেয়। এই সময়টা মানুষের জন্য খুব ক্ষতিকর হতে পারে। যখন হাতে কোন কাজ থাকে না, কোন কিছুতে মনোযোগ দেয়ার মত কিছু থাকে না, তখন এই শুন্যতা পূরণের জন্য মানুষ পর্নোগ্রাফির মত পাপ কাজে জড়িয়ে পড়ে।

সুতরাং, নিজেকে সবসময় ভালো কিছু নিয়ে ব্যস্ত রাখতে হবে (যেমন বই পড়া, বন্ধুদের সাথে দেখা করা, খেলাধুলা করা, কোন উন্নয়নমূলক কাজ করা, কৌতুক জাতীয় অনুষ্ঠান দেখা বা এমন কিছু করা যেটা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম নয়)। হাতে প্রচুর সময় থাকলে কখনো অলসভাবে বসে থাকা যাবে না, কারণ এই অলসতাই আপনাকে ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে।

আরো কিছু পরামর্শঃ

এই ৭ টি পয়েন্ট ছাড়াও আরো কিছু পরামর্শ আছে যেগুলো আমার কাজে লেগেছে।

--আমি আল্লাহ্‌র কাছে ওয়াদা করেছিলাম যে, আমি যদি আবার আগের অভ্যাসে ফিরে যাই তাহলে, একটানা ১২০ দিন রোযা রাখবো।

--প্রতিদিন আমি আয়নার সামনে দাঁড়াই এবং নিজেকে বলি ‘কক্ষনো না’, ‘কক্ষনো না’, বারবার বলি। (এর মানে হচ্ছে আমি কখনো আমার আগের জীবনে ফিরে যাব না)

--আমার একটা গোপন নোটবই আছে যেটা আমি শুধু এই কাজের জন্যই কিনেছি। আমি সেখানে বছরের প্রতিটি সফল দিনের পাশে একটি করে টিক চিহ্ন দেই, টিক চিহ্ন মানে হচ্ছে ঐদিন আমি পর্ন ভিডিও দেখিনি অথবা একটি ক্রস চিহ্ন যার মনে হচ্ছে ব্যর্থতা। আলহামদুলিল্লাহ্‌, আমার নোটবইতে এখন ৩৬৫টি টিক চিহ্ন রয়েছে, একটিও ক্রস নেই। আমি এই টিক চিহ্নগুলো সবসময় দেখি এবং এগুলো আমাকে বিজয়ের আনন্দ দান করে। আমি আমার নোটবইতে কোন ক্রস চিহ্ন দেখতে চাই না, কারণ এটা আমার আগের জীবনে ফিরে যাওয়া নির্দেশ করবে। এই ক্রসগুলো আমাকে হতাশ করবে, তাই আমি এগুলো পুরোপুরিভাবে পরিহার করার চেষ্টা করি।

আমি আশা করি এই পরামর্শগুলো সবার কাজে লাগবে। আমার জন্য দোয়া করবেন, আমি যাতে সঠিক পথে থাকতে পারি।

(লস্ট মডেস্টি অনুবাদ টিম কর্তৃক অনূদিত)